ঢাকা , শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশঃ
হান্ডিয়াল নিউজ২৪ ডটকম এ জরুরি  সংবাদকর্মী আবশ্যক। আবেদন করুন- ই-মেইলে onlynews.calo@gmail.com

বাংলা নববর্ষে পান্তা-ইলিশের একাল-সেকাল

দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। পুরোনোকে বিদায় করে আসছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটিকে বরণ করবেন বাঙালিরা। বাংলাদেশে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে পান্তা উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার সংস্কৃতি চালু ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

পান্তাভাত হলো পানিতে ভেজানো বাসি ভাত। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়েই লোকে পান্তা খেয়ে উঠত। অনেক সময় মানুষ পান্তা খেত শুধু লবণ মাখিয়ে। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ভাত সাধারণত পরদিন সকালে পান্তাভাত হিসেবে খাওয়া হতো। এই পান্তা খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের সানকি বা মাটির পাত্র ছিল না। তারা মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত তুলে নিয়ে কচুপাতায় বা কলাপাতায় করে খেত।

আসলে, গরমে-রোদে কাজ করার জন্য কৃষকের উপযোগী খাদ্য ছিল এই পানিভাত। সূর্য ওঠার পরপরই পান্তাভাত খেয়ে তারা কাজে বের হতো। এর সঙ্গে কখনো কখনো যোগ হতো একটু বেগুনপোড়া বা আলুসেদ্ধ। খুব কম সময়েই পান্তাভাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছের তরকারি। মাছ বলতেও সেসব মাছ, যেগুলো সাধারণত খালে-বিলে সহজে পাওয়া যেত। যেমন—কুচো চিংড়ি, ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি এগুলো।

সাধারণ মানুষের খাবার ছিল পান্তাভাত। তবে বিত্তবানেরা যে একেবারেই পান্তাভাত খেতে না, তা নয়। বাঙালি বড়লোক বন্ধু কৃষ্ণকান্ত নন্দীর বাড়িতে গিয়ে ভারতের প্রথম বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস পান্তাভাত আর কুচো চিংড়ি খেয়েছিলেন। আবার জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলায় পান্তাভাত খাওয়ার কথা লিখেছেন,বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন। ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তার আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চ্‌ড়ির সঙ্গে পানতা ভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।

দেখা যাচ্ছে, পান্তাভাতের সঙ্গে চিংড়ি যোগ হচ্ছে পদ হিসেবে। চিংড়ির মতো সহজে লভ্য অন্য মাছও পান্তাভাতের অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় না। ইলিশ ছিল দামি মাছ। ইলিশ যদি খেতেই হয়, তবে গরম ভাতেই খাওয়ার চল ছিল। সাধারণের পাতে সহজে ইলিশ উঠত না। তবে পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো রীতি সাহিত্য কিংবা ইতিহাসে নেই।

আশির দশকে ঢাকায় পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে। এটি সারা দেশে জনপ্রিয় হতেও দেরি হয়নি। বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে এখন ভর করেছে পান্তা-ইলিশ। উৎসবে মানুষ এক হতে চায়; শহরের মানুষও নতুন বছরের প্রথম দিনে এক হয়। ‘বৈশাখী মেলা’ নতুন বছরের মিলনের প্রধান উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি এক হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের সূত্রে নববর্ষ উদ্‌যাপনে। এরপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার সূত্রে নগর মানুষ এক হয়েছে। এসব আয়োজন-অনুষ্ঠান যতই জনপ্রিয় হতে থাকে, ততই নাগরিক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে রমনা-শাহবাগ এলাকায়।

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সুযোগটি গ্রহণ করেন। তারা নিজেদের আগ্রহে অস্থায়ী দোকান দিয়ে পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। পান্তাভাত হাজার বছরের বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য, আর ইলিশ মূলত বঙ্গ-উপকূলের মাছ—এই ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে তারা পান্তা আর ইলিশকে জনপ্রিয় করেছেন। যদিও একত্রভাবে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্যিক কোনো সূত্র নেই। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ তো থাকেই, আরও থাকে আলুভর্তা, শুটকিভর্তা, বেগুনভর্তা ও পোড়া মরিচ। এসব খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকি।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কোনও সম্পর্কের বিষয়টি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এখন সেই ভুল ভেঙেছে। এখন আর পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয়।

তবে শহরের মানুষ যা নিয়েই মত্ত থাকুক না কেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ নতুন বছরের প্রথম দিনে সাধ্যমতো ভালো খাওয়ার চেষ্টা করে। এদিন সকালে তারা মিষ্টি খেয়ে দিন শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, আগের রাতের খাবারে তারা তিতাজাতীয় কোনো পদ রাখে। এই তিতা খাবারটি তাদের কাছে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রতীক।

নিউজ ট্যাগ :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

বাংলা নববর্ষে পান্তা-ইলিশের একাল-সেকাল

আপলোড সময় : ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

দরজায় কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। পুরোনোকে বিদায় করে আসছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটিকে বরণ করবেন বাঙালিরা। বাংলাদেশে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে পান্তা উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার সংস্কৃতি চালু ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

পান্তাভাত হলো পানিতে ভেজানো বাসি ভাত। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়েই লোকে পান্তা খেয়ে উঠত। অনেক সময় মানুষ পান্তা খেত শুধু লবণ মাখিয়ে। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ভাত সাধারণত পরদিন সকালে পান্তাভাত হিসেবে খাওয়া হতো। এই পান্তা খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের সানকি বা মাটির পাত্র ছিল না। তারা মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত তুলে নিয়ে কচুপাতায় বা কলাপাতায় করে খেত।

আসলে, গরমে-রোদে কাজ করার জন্য কৃষকের উপযোগী খাদ্য ছিল এই পানিভাত। সূর্য ওঠার পরপরই পান্তাভাত খেয়ে তারা কাজে বের হতো। এর সঙ্গে কখনো কখনো যোগ হতো একটু বেগুনপোড়া বা আলুসেদ্ধ। খুব কম সময়েই পান্তাভাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছের তরকারি। মাছ বলতেও সেসব মাছ, যেগুলো সাধারণত খালে-বিলে সহজে পাওয়া যেত। যেমন—কুচো চিংড়ি, ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি এগুলো।

সাধারণ মানুষের খাবার ছিল পান্তাভাত। তবে বিত্তবানেরা যে একেবারেই পান্তাভাত খেতে না, তা নয়। বাঙালি বড়লোক বন্ধু কৃষ্ণকান্ত নন্দীর বাড়িতে গিয়ে ভারতের প্রথম বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস পান্তাভাত আর কুচো চিংড়ি খেয়েছিলেন। আবার জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলায় পান্তাভাত খাওয়ার কথা লিখেছেন,বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন। ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তার আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চ্‌ড়ির সঙ্গে পানতা ভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।

দেখা যাচ্ছে, পান্তাভাতের সঙ্গে চিংড়ি যোগ হচ্ছে পদ হিসেবে। চিংড়ির মতো সহজে লভ্য অন্য মাছও পান্তাভাতের অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় না। ইলিশ ছিল দামি মাছ। ইলিশ যদি খেতেই হয়, তবে গরম ভাতেই খাওয়ার চল ছিল। সাধারণের পাতে সহজে ইলিশ উঠত না। তবে পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো রীতি সাহিত্য কিংবা ইতিহাসে নেই।

আশির দশকে ঢাকায় পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে। এটি সারা দেশে জনপ্রিয় হতেও দেরি হয়নি। বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে এখন ভর করেছে পান্তা-ইলিশ। উৎসবে মানুষ এক হতে চায়; শহরের মানুষও নতুন বছরের প্রথম দিনে এক হয়। ‘বৈশাখী মেলা’ নতুন বছরের মিলনের প্রধান উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি এক হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের সূত্রে নববর্ষ উদ্‌যাপনে। এরপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার সূত্রে নগর মানুষ এক হয়েছে। এসব আয়োজন-অনুষ্ঠান যতই জনপ্রিয় হতে থাকে, ততই নাগরিক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে রমনা-শাহবাগ এলাকায়।

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সুযোগটি গ্রহণ করেন। তারা নিজেদের আগ্রহে অস্থায়ী দোকান দিয়ে পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। পান্তাভাত হাজার বছরের বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য, আর ইলিশ মূলত বঙ্গ-উপকূলের মাছ—এই ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে তারা পান্তা আর ইলিশকে জনপ্রিয় করেছেন। যদিও একত্রভাবে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্যিক কোনো সূত্র নেই। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ তো থাকেই, আরও থাকে আলুভর্তা, শুটকিভর্তা, বেগুনভর্তা ও পোড়া মরিচ। এসব খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকি।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কোনও সম্পর্কের বিষয়টি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এখন সেই ভুল ভেঙেছে। এখন আর পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয়।

তবে শহরের মানুষ যা নিয়েই মত্ত থাকুক না কেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ নতুন বছরের প্রথম দিনে সাধ্যমতো ভালো খাওয়ার চেষ্টা করে। এদিন সকালে তারা মিষ্টি খেয়ে দিন শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, আগের রাতের খাবারে তারা তিতাজাতীয় কোনো পদ রাখে। এই তিতা খাবারটি তাদের কাছে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রতীক।