ঢাকা, রাজশাহী অথবা খুলনা-যশোর—সবদিক থেকেই খুব সহজে চলে আসা যায় পাবনায়। বাসের সঙ্গে রয়েছে ট্রেনের সুবিধা। ট্রেনে এলে ব্রিটিশ আমলের তৈরি পাকশী, ঈশ্বরদী জংশন অথবা চাটমোহর, ভাঙ্গুরা—যেকোনো স্টেশনে নামা যায়। চাটমোহর অথবা ভাঙ্গুরা স্টেশনে নামলে প্রথমেই উপভোগ করা যাবে চলনবিলের সৌন্দর্য। অন্যদিকে ঈশ্বরদী অথবা পাকশী স্টেশনে নামলে দেখা যাবে ব্রিটিশদের নানা স্থাপনা ও রুশদের নতুন শহর।
অপরূপ পাকশী-রূপপুর
ট্রেন থেকে পাকশী স্টেশনে নামলেই মনে হবে কোনো পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে সবুজের সমারোহ। প্রথমেই চোখে পড়বে ব্রিটিশদের গড়া লালরঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। শত বছর পরও লালরঙা লোহার সেতুটি এখনো অক্ষত। দূরে চোখ মেললেই দেখা যায় লালন শাহ সেতু ও নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রকৌশলবিদ্যার যুগলবন্দীতে চোখ জুড়িয়ে যাবে নিমেষেই।
স্টেশন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে সমতলে। কয়েক পা এগোলেই পদ্মা নদী। এবার নদীর জেগে ওঠা চরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারবেন জোড়া দুই সেতুর সৌন্দর্য। পদ্মা নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ কানে লাগবে। মন চাইলে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়াতে পারবেন নদীতে। উপভোগ করতে পারবেন চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচেই মিলবে ভাড়া নৌকা। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখর থাকে পদ্মার এই জেগে ওঠা চরটি। সকাল-বিকেল মনে হয় যেন এক মিলনমেলা। চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্য বোঝা যাবে না।
জোড়া সেতু
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু। লালন শাহ সেতুটি পদ্মা নদীর ওপর ১ হাজার ৭৮৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৭ দশমিক ৫ মিটার দুই লেনবিশিষ্ট। সেতুর উভয় পাড়ে দুটি টোল প্লাজা যেন তার শ্রীবৃদ্ধি করেছে। সেতুর পূর্ব প্রান্তে ১০ কিলোমিটার এবং পশ্চিম প্রান্তে ৬ কিলোমিটার রাস্তা অন্য রকম সৌন্দর্য তুলে ধরেছে।
অন্যদিকে রেল যোগাযোগের জন্য ১৯১০ সালে পদ্মার ওপর ব্রিটিশরা তৈরি করেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ৫২ ফুট উচ্চতার ১৫টি স্প্যান এবং দুই পাশে শক্ত কাঠামোর ল্যান্ড স্প্যানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট দীর্ঘ এই ব্রিজ। জোড়া সেতু ও পদ্মার সৌন্দর্য উপভোগ করে এগোতে পারেন সামনের দিকে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সদর দপ্তর
পাকশী গ্রামেই আছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সদর দপ্তর। ব্রিটিশ স্থাপনার সঙ্গে এখানে রয়েছে শত বছরের পুরোনো শতাধিক বিশাল আকৃতির কড়ইগাছ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরির পর ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল এই কার্যালয়। তখনই রোপণ করা হয়েছিল কড়ইগাছগুলো। লালরঙা ভবনগুলোর সঙ্গে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।
ঘুরতে ঘুরতে দেখে নেওয়া যাবে আরও এক কালের সাক্ষী দেশের প্রথম ন্যারো গ্রেজ ট্রেনটি। ১৮৯৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রূপসা-বাগেরহাট রুটে প্রথম এই ট্রেন চালু করা হয়েছিল। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের সামনে দর্শনার্থীদের জন্য ট্রেনটি প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। ট্রেনটির পাশে রাখা হয়েছে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর নিক্ষেপ করা বোমার অংশবিশেষ।
রুশদের নতুন শহর
পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রাম। এখানেই তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রুশদের নতুন শহর। পাবনা-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে নির্মাণাধীন রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। খুব কাছ থেকেই দেখা যাবে প্রকল্পটি, তবে ভেতরে ঢুকতে অনুমতি মেলা বড় কঠিন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখে মাত্র এক কিলোমিটার এগোলেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিন সিটি’। গ্রামটির নাম ‘দিয়ার সাহাপুর’।
এখানে প্রায় ছয় হাজার রুশ নাগরিক বসবাস করেন। তাঁদের পছন্দ বিবেচনায় শহরের সামনেই তৈরি হয়েছে নান্দনিক সব বিপণিবিতান ও খাবার রেস্তোরাঁ। এসব বিপণিবিতানে যেমন মিলবে রুশদের পছন্দের পণ্য, তেমনই রেস্তোরাঁগুলোয় বসে নেওয়া যাবে রুশ খাবারের স্বাদ। রাশিয়ান নাগরিকদের আনাগোনা, খাবার ও দোকানপাট সব মিলিয়ে মনে হবে এ যেন গ্রামের ভেতর ‘এক খণ্ড রাশিয়া’।
ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন ও বেনারসিপল্লি
ব্রিটিশদের আরেক স্থাপনা দেশের প্রথম জংশন স্টেশনটি ঈশ্বরদী উপজেলা সদরে। শত বছরের অক্ষত স্টেশনের ভবনগুলো। এর পাশেই রয়েছে বিহারিদের বেনারসিপল্লি। স্টেশন দেখার পাশাপাশি ঘুরে যাওয়া যাবে বেনারসিপল্লি। ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনো নানা রঙের বেনারসি শাড়ি তৈরি হয় এই পল্লিতে। বিহারি কারিগর ও তাঁদের বংশধরেরা আছেন এখানে।
ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি খুব কম দামেই বেনারসি শাড়ি কেনা যাবে এই পল্লি থেকে। ঘুরতে ঘুরতেই স্টেশনবাজার থেকে স্বাদ নেওয়া যাবে ঈশ্বরদীর রেশমি জিলাপির। স্থানীয়ভাবে বেশ কদর এই রেশমি জিলাপির। আছে বিহারিদের তৈরি বাহারি মসলা পান।
প্রকৃতির লীলাভূমি চলনবিল
চলনবিলের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে থই থই জলে উথালপাতাল ঢেউয়ের কথা। তবে চলনের এ রূপ বর্ষার। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে। বর্ষায় সাগরের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ংকর রূপ ধরে এ বিল। শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে ম–ম করে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের নিধুয়া পাথার এবং গ্রীষ্মে চলনের রূপ রুক্ষ। যেকোনো ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। এরপর ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে।
চাটমোহর শাহি মসজিদ
চাটমোহর শাহি মসজিদ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন মসজিদ, যা জেলার চাটমোহর উপজেলার বাজারের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মসজিদটি মাসুম খাঁ কাবলির শাহী মসজিদ নামেও পরিচিত। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে আবুল ফতেহ মোহাম্মদ মাসুম খাঁ (যিনি মাসুম খাঁ কাবলি নামে পরিচিত) নামে সম্রাট আকবরের এক সেনাপতির অর্থায়নে তাঁর ভাই খান মোহাম্মদ কাকশাল মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির ভেতরে দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। ক্ষুদ্র পাতলা নকশাখচিত লাল জাফরি ইটে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দেয়াল ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি প্রশস্ত। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির সামনে ইঁদারার গায়ে কালেমা তাইয়েবা লিখিত আছে। মসজিদের ভেতরে একটি কালো বর্ণের ফলক ছিল, যা এখনো রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
জোড়বাংলা মন্দির
পাবনা জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র দক্ষিণ রাঘবপুরে জোড়বাংলা মন্দিরটি অবস্থিত। এটি দেখতে জোড়া বাংলো ঘরের মতো বলে জোড়বাংলা বলা হয়। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত কাহিনিতে জানা যায় যে ব্রজমোহন ক্রোড়ী নামে মুর্শিদাবাদের নবাবের এক তহশিলদার আঠারো শতকের মধ্যভাগে এ মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি আয়তনে বড় না হলেও বাংলাদেশের জোড়বাংলা নিদর্শনের মধ্যে সুন্দরতম। এ স্থাপত্য নিদর্শনটি কেবল ইটের পর ইট গেঁথে নির্মিত একটি ইমারত নয়, বরং শিল্পীর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে খণ্ড খণ্ড টেরাকোটা ফলকে রচিত স্থাপত্যের একটি সার্থক কাব্য।
তাড়াশ জমিদার ভবন
জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ বিল্ডিং অবস্থিত। পাবনার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা এবং পুরোনো বলে পরিচিত ছিলেন তাড়াশের জমিদার। তাঁর এস্টেট ছিল প্রায় ২০০ মৌজা নিয়ে। জানা যায়, ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের আতঙ্কে এ জমিদার পরিবার তাদের পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক তাড়াশ বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভবনটি দ্বিতলবিশিষ্ট। এর প্রধান ফটকটি বেশ দৃষ্টিনন্দন।
শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ
জেলা সদরের হিমায়েতপুর ইউনিয়নের হিমায়েতপুর গ্রামে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ (আশ্রম ও মন্দির) অবস্থিত। এখানে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশ-বিদেশের ভক্তরা এখানে আসেন। আশ্রমের পাশেই ৫০০ শয্যার পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এটি দেশের সবচেয়ে বড় মানসিক হাসপাতাল।
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা
জেলা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা। এটি সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি। এই বাড়িতে তিনি মা–বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। সুচিত্রা সেনের বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত তখন পাবনা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে ছিলেন। ১৯৬০ সালে করুণাময় দাশগুপ্ত বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ২০১৪ সালে বাড়িটিতে জেলা প্রশাসন সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা করেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো