
রাজধানীর উপকণ্ঠের ঘনবসতিপূর্ণ এক জনপদ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত এই উপজেলার ইউনিয়নটির দূরত্ব বলতে শুধু মাঝখানে বয়ে চলা স্বল্প প্রশস্তের নদী বুড়িগঙ্গা। রাজধানী লাগোয়া হলেও এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় এখনো লাগেনি আধুনিকতার তেমন কোনো ছোঁয়া, রাস্তাঘাটও অনুন্নত। অনেকটাই গ্রামীণ আবহের এই জনপদে অবৈধ সুদের কারবারের জমজমাট একটি চক্র গড়ে তুলেছেন স্থানীয় থানার দুই পুলিশ সদস্যের স্ত্রী। গ্রামীণ, সহজ-সরল, অভাব-অনটনে থাকা মানুষদের টার্গেট করে ধারের নামে ঋণের ফাঁদে ফেলে চক্রটির সদস্যরা। যে ফাঁদে পা দিয়ে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ। ধার নেওয়া মূল টাকার কয়েকগুণ পরিশোধের পরও মুক্তি মেলেনি চক্রবৃদ্ধি সুদ হারের ঋণের বোঝা থেকে। এমনকি ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় বেশ কয়েকজনকে থানায় নিয়ে শারীরিক নির্যাতনেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঋণের মূল টাকা পরিশোধের পর চক্রবৃদ্ধি সুদের মুনাফা না পেয়ে ঋণগ্রহীতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানোরও ঘটনাও ঘটেছে, যার সিসি ক্যামেরা টিভি ফুটেজ কালবেলার হাতে এসেছে। এ ছাড়াও ব্যবসায়ীদের দোকান থেকে টাকা না দিয়ে শাকসবজিসহ দৈনন্দিন বাজার, এমনকি টেইলার্স থেকে জোর করে জামাকাপড় নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। যে দুই পুলিশ সদস্যের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে এত বিস্তর অভিযোগ, তারা হলেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাচ্চু এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কনস্টেবল মো. রাসেল।
একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের আইনে ব্যক্তি পর্যায়ে সাধারণত সুদের ব্যবসা বা দাদন কারবারের কোনো সুযোগ নেই, এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব কারবার বাংলাদেশ দণ্ডবিধি (Penal Code), ঋণ নিয়ন্ত্রণ আইন ও অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও আদায়ের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলা-জেলা সমবায় অফিস থেকে সমবায় সমিতির অনুমোদন নিয়ে শুধু ওই সমিতির সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ ও আদায়ের সুযোগ আছে। তবে কোনোভাবেই সরকারি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি নিয়মকানুন না মেনে ব্যক্তি পর্যায়ে সুদে ঋণের কারবার পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।
শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিধবা নারী সাজু বেগম। সংসারে রয়েছে তিন মেয়ে। পেটের তাগিদে ইকুরিয়ার টিলাবাড়ি শহীদ মোল্লার বাড়ির ছোট্ট একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি টুকটাক বিক্রি করেন গজ কাপড় ও থ্রি পিস। সঙ্গে শাকসবজি ও কিছু কাঁচামালও বিক্রি করেন। ক্ষুদ্র এই ব্যবসার পরিধি আরও বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখিয়ে কোনো মুনাফা না নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সাজু বেগমকে ৫০ হাজার টাকা ধার হিসেবে দেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এসআই মো. সাচ্চুর স্ত্রী সাদিয়া আক্তার। যদিও ৫০ হাজার টাকা নিলেও স্বামীহারা এই নারী পরিশোধ করেন ৬০ হাজার টাকা। এরপর আরও ১ লাখ টাকা দাবি করেন সাদিয়া। সেই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় গভীর রাতে তার দোকানে হামলা চালিয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়, চলে লুটপাটের চেষ্টাও; কিন্তু সাজু বেগমের চিৎকারে আশপাশের মানুষ এগিয়ে এলে হামলাকারীরা সটকে পড়ে। এ ঘটনার সিসি ক্যামেরা টিভির মোট ৭ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের দুটি ফুটেজ কালবেলার হাতে এসেছে। এসব ফুটেজে এসআই সাচ্চু ও কনস্টেবল রাসেলের স্ত্রী-সন্তানদের উপস্থিতি দেখা গেছে। চলতি বছরের ২৮ জুন রাত ১১টা ১৯ মিনিটে ওই দুই পুলিশ সদস্যের স্ত্রী হানা দেন সাজু বেগমের দোকানে। সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজে ওই দুই নারীকে টাকার জন্য সাজু বেগমকে শাসাতে দেখা যায়। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে চলে বাগবিতণ্ডা। এ ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জমা দেন সাজু বেগম। এতে ওই নারী উল্লেখ করেন, এসআই সাচ্চুর স্ত্রী সাদিয়া তাকে ৫০ হাজার টাকা বিনা লাভে ধার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এতে রাজি হলে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ১০০ টাকার ৩টি স্ট্যাম্পে ঋণ চুক্তিপত্র করেন এবং তার স্বাক্ষরযুক্ত একটি ব্যাংক চেকে ৫০ হাজার টাকা লিখে নেন। এরপর তাকে ৫০ হাজার টাকা দেন সাদিয়া আক্তার।
অভিযোগে সাজু বেগম আরও উল্লেখ করেন, ঋণ চুক্তিপত্রে লিখিতভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ওই টাকার জন্য কোনো মুনাফা দিতে হবে না; কিন্তু টাকা দেওয়ার পর প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফা দাবি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে মুনাফাসহ মোট ৪৫ হাজার টাকা নগদ গ্রহণ করেন। এরপর ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী সাজু বেগমের দোকান থেকে এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি ১৩০০ টাকা দামের ১২টি থ্রি-পিস নিয়ে যান। সে হিসেবে প্রতিটি থ্রি-পিসের দাম ১৩০০ টাকা করে মোট ১৫৬০০ টাকার থ্রি-পিস নেওয়া হয় সাজু বেগমের কাছ থেকে।
এরই মধ্যে গত ২৯ জুন সাদিয়া আক্তার বেশ কয়েকজন লোক নিয়ে তার কাপড়ের দোকানে হামলা চালিয়ে তাকে মারধর করেন। এ সময় তারা দোকান থেকে মালপত্র লুটের চেষ্টা করে।
নিজের দুর্দশার চিত্র কালবেলার কাছে তুলে ধরে সাজু বেগম বলেন, ‘আমি তার (সাদিয়া আক্তার) কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার পর সে বিভিন্ন সময়ে আমার দোকান থেকে বিভিন্ন তরকারি (সবজি) নিজে হাতে তুলে নিয়ে গেছে। এগুলোর কোনো টাকা দেয়নি। একদিন আবার ১২ পিস থ্রি পিস নিয়ে গেছে। ৫০ হাজার টাকা ধার দিলেও মালপত্রসহ সব মিলে ৬০ হাজার টাকার ওপরে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে; কিন্তু এখনো আরও ১ লাখ টাকা দাবি করছে। টাকা দিতে না চাইলে আমার দোকানে হামলা করে, আমাকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। আমি আমার পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নূপুর আক্তার নামে আরেক নারী। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ননাসের (ননদের) ছেলে ইমরান হোসেন জয়কে পুলিশের চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা নেয় কনস্টেবল জাহিদের স্ত্রী ববি। আমি এই টাকা সাদিয়া আক্তারের কাছ থেকে ধার করে এনে দিই। এর মধ্যে প্রথম মাসের সুদ হিসাবে ১ লাখ টাকা কেটে রাখেন সাদিয়া। এ ছাড়া ববির সঙ্গে সাচ্চুর বউয়ের (স্ত্রী) একটি লেনদেন থাকায় আরও ৬০ হাজার টাকা কেটে রেখে আমাকে ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেন। সাদিয়া আবার আমার ধার নেওয়া টাকা কনস্টেবল রাসেলের কাছ থেকে নিয়ে (ঋণের কথিত হাতবদল) আমাকে রাসেলের আন্ডারে (অধীনে) দিয়ে দেন। এরপর কনস্টেবল জাহিদ ও তার স্ত্রী ববির কোনো খোঁজ নেই। আমার ননাসের ছেলেকে চাকরিও দিতে পারেনি। এ নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গেও ঝামেলা হয়েছে। এখন আমার সংসার ভাঙার উপক্রম হয়েছে।’
মো. হাবিব নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও মেয়ে এসআই সাচ্চুর বাসায় কাজ করত। তাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সাচ্চু ও কনস্টেবল রাসেল দুজনে আত্মীয়। আমি সাচ্চুর কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা ধার নেই। পরে টাকা দিয়ে দেওয়ার পর আরও টাকা দাবি করা হয়। সেটা না দিলে কনস্টেবল রাসেল আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে থানায় নিয়ে যান। পরে আমার বাড়িওয়ালার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তাদের দিয়ে আমি ছাড়া পাই। এই ঝামেলার কারণে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে তাদের বাসায় কাজ করতে বাধা দিই; কিন্তু তারা ছাড়তে চায় না। পরে আমি রাজি না হলে স্ত্রী ও মেয়ের বিরুদ্ধে স্বর্ণচুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয়।’
এই চক্রের ঋণের ফাঁদে পড়ে এখন বলতে নিঃস্ব স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী মো. সোহাগ। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও আমার দুইটি ভাতের হোটেল ও একটি চায়ের দোকান ছিল। কিন্তু পুলিশের স্ত্রীর ঋণের ফাঁদে পড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। মাত্র ৩ লাখ টাকা ধার নিয়ে দুই গুণেরও বেশি পরিশোধের পর এখনো ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দাবি করছেন। একে একে দুইটি হোটেল বিক্রি করে সুদের টাকা পরিশোধ করেছি। এখন শুধু ছোট একটি দোকানে চা, পুড়ি, শিঙাড়া বিক্রি করে সংসার চালাই। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।’
সোহাগ আরও বলেন, ‘এই এলাকায় আমার মতো এমন ভুক্তভোগী অসংখ্য। ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। মুখ খুললেই ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এই এলাকার মানুষ একপ্রকার জিম্মি ওই দুই পুলিশের স্ত্রীর কাছে।’
ঋণের ফাঁদে পড়া এসব ভুক্তভোগীর করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঋণ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কনস্টেবল মো. রাসেল। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি তার কাছে ঋণের টাকা পাব। সে টাকা দিবে না?’
এরপর তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে মিটমাট হয়েছে। আপনার (কালবেলার এই প্রতিবেদক) মতো আরও অনেক সাংবাদিক আমার কাছে আসছে।’ এরপর তিনি স্থানীয় এক ‘গণমাধ্যমকর্মীর’ নাম উল্লেখ করে এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
আর তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ধার দেওয়ার নামে চক্রবৃদ্ধি সুদে ঋণের কারবারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এসআই মো. সাচ্চু বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে আইন সবার জন্য সমান। কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকলে সে আইনের আওতায় আসবে।’
অন্যদিকে নিজের অধীনস্থ একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে চক্রবৃদ্ধি সুদে ঋণের কারবারের বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল হক ডাবলু বলেন, ‘এটি খুবই জঘন্য কাজ। কেউ পুলিশি ক্ষমতা ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনার কাছ থেকেই আমি বিষয়টি প্রথম জানলাম, খোঁজখবর নিয়ে দেখব।’

‘ভোটকেন্দ্রে থাকবে বডি ক্যামেরা ও সিসিটিভি, উড়বে ড্রোন’ 












