খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোমের একনায়ক জুলিয়াস সিজার ঠিক করলেন, সূর্যের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন ক্যালেন্ডার হোক। ডাকলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ সোসিজেনেসকে। তাঁর পরামর্শে ঠিক পরের বছর, ৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পূর্ণ হলো সিজারের ইচ্ছা। প্রবর্তিত হলো নতুন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার, যেটিতে বছরের শুরু হলো ১ জানুয়ারি থেকে। ওই ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরে একটি অতিরিক্ত দিনও চালু হলো, যাকে আমরা বলি লিপইয়ার বা অধিবর্ষ। তবে প্রতি চার বছর পরপর এই একটি বাড়তি দিনের কারণে বছরের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেল প্রায় ১১ মিনিট করে।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের এই ১১ মিনিটের ত্রুটি বছরের পর বছর জমতে জমতে জটিলতা আরও বেড়ে গেল। ১৫ শতকের মাঝামাঝিতে একটা বছর সৌর চক্র থেকে পিছিয়ে পড়ল প্রায় ১০ দিন। এই গরমিল সংশোধনের উদ্যোগ নিল ক্যাথলিক গির্জাগুলো। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ প্রবর্তন করলেন নতুন একটি ক্যালেন্ডার, যা এখনকার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার অনুসারেই আজ বছরের প্রথম দিন, খ্রিষ্টীয় নববর্ষ।
পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ ঠিক করে দিলেন, কোনো শতাব্দীর বছর (যেমন ১৭০০) অধিবর্ষ হবে না, যদি না বছরটি ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য হয় (যেমন ২০০০)। আর ওই ক্যালেন্ডারেও বছর শুরুর দিন বহাল থাকল জানুয়ারির ১ তারিখে।
বিনা বাক্যব্যয়ে ক্যালেন্ডারটি মেনে নিল ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন। তবে অনেক দেশ মেনে নেয়নি। গ্রেট ব্রিটেন ও তার আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে ক্যালেন্ডারটি চালু হলো ১৭৫২ সালের পরে। তার আগে এসব অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপিত হতো ২৫ মার্চে। ১ জানুয়ারি খ্রিষ্টীয় নববর্ষ হিসেবে ঘটা করে উদ্যাপিত হতে শুরু করল ১৯ শতকের শুরু থেকে।
আমাদের এই অঞ্চলে, বিশেষত পূর্ববঙ্গে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস ঝাপসাই বলা চলে। লোকসংস্কৃতি-গবেষক সাইমন জাকারিয়ার বক্তব্য, ‘আদতে এই অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ কখনো উৎসব হিসেবে আসেনি।
না আসার যথেষ্ট কারণও আছে। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ বছরের হিসাব রাখত মূলত বাংলা পঞ্জিকা ধরে। ব্রিটিশ সাহেবরা এই মুলুকে পা রাখার পর খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে চোখ না রাখলে চলত না। দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে বেতন-ভাতা সবই চলত ওই ক্যালেন্ডার ধরে। ফলে অবিভক্ত বাংলায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষ নিয়ে যত আয়োজন, সব হতো ব্রিটিশ সাহেবদের REDMI NOTEদা 2 ভাবে গির্জা ও চা-বাগানের বাবুদের ঘরে জ্বলত উৎসবের বাতি।
বাঙালি অবশ্য সাহেবদের এই আতিশয্য সহজে হজম করেনি। তার প্রমাণ মেলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘ইংরেজি নববর্ষ’ নামক ব্যঙ্গাত্মক কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘খৃষ্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর/ প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর/… বেরিবেন্ট সেরিটেন্ট মেরিমেন্ট যাতে/ আগেভাগে দেন গিয়া শ্রীমতীর হাতে/…হিপ হিপ হুর রে ডাকে হোল ক্লাস/ ডিয়ার ম্যাডাম ইউ টেক দিস গ্লাস।
উৎসবে শামিল না হলেও খ্রিষ্টীয় নববর্ষের পয়লা দিনে বাংলার কেউ কেউ পদক-উপাধি বরণ করেছেন ঠিকই। ১৯৪১ সালের ২ জানুয়ারির যুগান্তর পত্রিকায় যেমন একটি খবর বেরিয়েছিল ‘নববর্ষে পদক বিতরণ’ শিরোনামে। তাতে বলা, হচ্ছে, ‘ইংরাজী নববর্ষ উপলক্ষে নিম্নলিখিত কয়েকজন বাঙ্গালী রায় সাহেব উপাধী পাইয়াছেন…।
ঢাকায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস নেই বললেই চলে। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারির পত্রিকাগুলোয় যেমন খ্রিষ্টীয় নববর্ষ নিয়ে বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। থাকার কথাও নয়। সে সময় দেশের যা অবস্থা, তাতে উৎসব- আয়োজনের প্রশ্নই আসে না। তবে ১৯৭০ দশকের শেষ দিকের কথা মনে করলেন ফিডব্যাক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ফোয়াদ নাসের বাবু। তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমরা বাজিয়েছিলাম।
ঢাকায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের শিকার হন বাঁধন নামের এক তরুণী। গণমাধ্যমে সেই ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শুরু হয় আলোচনার ঝড়।
মানুষ এখন বছরের শেষ দিনে চোখ রাখে কখন কোন রাস্তা বন্ধ থাকবে, সে খবরে। নানান বিধিনিষেধের পরও ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর ছাদ থেকে ঠিকই আতশবাজি ও ফানুস উড়ে যায় আকাশপানে। এতে আগুন লাগে, আতশবাজি ফাটাতে গিয়ে কিশোর, তরুণ ও যুবকের প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনার খবরও চোখে পড়ে। আর আতশবাজি ও ফানুস হামেশা প্রাণ নেয় শত শত পাখির, ভয়ে দিগ্বিদিক ছুটে যায় রাস্তার কুকুর।
সব মিলিয়ে অবিভক্ত বাংলা, পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ-কোনো ভূখণ্ডেই খ্রিষ্টীয় নববর্ষ ঠিক উৎসব হিসেবে উদ্যাপিত হয়নি বলা চলে; কিন্তু এখন সব হিসাব রাখা হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ধরে। নতুন বছরে ঘরের দেয়ালে ঝোলাতেই হয় নতুন ক্যালেন্ডার।
সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।