আপডেট সময় :
বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ,
১০.৫৩ অপরাহ্ণ
১০৫
বার পড়া হয়েছে
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশের মানুষ যখন বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা, তখনও পাবনার চাটমোহরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা অবস্থান করছিল। চুড়ান্ত বিজয়ের ৪ দিন পর আজকের এই দিনে (২০ ডিসেম্বর) চাটমোহর হানাদার মুক্ত হয়।
একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হলো সারাদেশে। পাবনার চাটমোহর উপজেলার জনগণও সেদিনটিতে পিছিয়ে থাকেননি।
সেদিন প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে উপজেলা শহর সহ গ্রাম-গ্রামান্তর। শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি।
‘৭১ এর এপ্রিলে পাকি হানাদার বাহিনী ২ বার পাবনা শহরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে পালিয়ে যায়।
মে মাসের শেষ দিকে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে নগরবাড়ী ঘাট অতিক্রম করে পাবনায় ঢুকে পড়ে। এসময় তারা পর্যায়ক্রমে পাবনার চাটমোহরসহ বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে।
বর্ধিষ্ণু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত চাটমোহর উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় পাকি বাহিনী। শহরের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের শান্তি আলোচনার নাম করে পুলিশ দিয়ে থানায় ডেকে এনে তাদের আটক করা হয়। তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক চাটমোহর শাখা লুট করে নেয় হানাদাররা। ব্যাংক ম্যানেজার আবুল কালাম খানসহ ২ জন গার্ডকে ওই সময় তারা গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যতীন কুণ্ডু, রঘুনাথ কুণ্ডু , ঝরু ঠাকুর ও অশ্বিনী কুণ্ডুকে।
চাটমোহর থানার তৎকালীন ওসি আব্দুল বাতেন ও সেকেন্ড অফিসার আবুল কাশেমের সাহসিকতায় থানায় আটক ব্যক্তিরা প্রাণে রক্ষা পান। এ ২ জন পুলিশ তালা ভেঙে তাদের পালাতে সাহায্য করে এবং নিজেরাও পালিয়ে যান।
পাক হানাদাররা এসব হত্যা ও তাণ্ডব চালিয়ে পাবনা চলে যায়। কয়েকদিন পরে এসে তারা চাটমোহর থানা দখলে নিয়ে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। এরপর তারা রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করে তাদের সহায়তায় অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে চাটমোহর দখলে রাখে।
নভেম্বরের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেন। এলাকাবাসীর সহায়তায় থানা আক্রমণের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। হানাদারদের ওপর ছোট খাটো চোরাগোপ্তা হামলাও চলতে থাকে। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরের দিকে এগুতে থাকে।
এরই মাঝে ১১ নভেম্বর পার্শ্ববর্তী তাড়াশ উপজেলার শাহ শরীফ জিন্দানীর (রাঃ) পণ্যভূমি নওগাঁয় অবস্থানকারী মুক্তিবাহিনী শেষ রাতে হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। এ সময় পলাশডাঙ্গায় প্রায় ১২ ঘণ্টার এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় ৩শ’ পাকি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। তৎকালীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অধিনায়ক ছিলেন আবদুল লতিফ মির্জা।
এ খবরে চাটমোহরের হানাদাররা দমে যায় এবং তারা বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দেয়। ১৩ ডিসেম্বর থানা আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ, এসএম মোজাহারুল হক, আমজাদ হোসেন লাল ও ইদ্রিস আলী চঞ্চলের নেতৃত্বে ব্যাপক আক্রমণের মুখে হানাদাররা থানায় আটকা পড়ে। শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে থানাটিকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে।
এদিন হানাদারদের হাতে আটকা পড়ে উপজেলার রামনগর গ্রামের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা দুই সহোদর মোসলেম উদ্দিন ও আবু তালেব। পরদিন সকালে তাদের গুলি করে হত্যা করে তারা। মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ ডিসেম্বর থানা আক্রমন করে হানাদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে হত্যা করে শের আফগান নামের এক দুর্র্ধষ হানাদারকে।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে সাদা পতাকা উড়িয়ে ফ্লাগ মিটিং এর আহবান জানায়। এ অবস্থায় দু’দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকে। ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ, এসএম মোজাহারুল হক ও ইদ্রিস আলী চঞ্চল থানার মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন। বেলা ২টায় ফিরে এসে জানায়, পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। তারা মিত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণের শর্ত দিয়েছে।
অবশেষে ২০ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পাবনায় গিয়ে জেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলকে মিত্র বাহিনীর পোশাক পরিয়ে চাটমোহরে নিয়ে আসেন। এদিন বেলা ২টায় নকল মিত্র বাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলের কাছে হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদেরকে ঘোড়ার গাড়িতে করে পাবনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই বিজয় দিবসের ৪ দিন পর ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর হানাদার মুক্ত হয়।
সেই থেকে ২০ ডিসেম্বর ‘চাটমোহর মুক্ত দিবস’ হিসেবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও চাটমোহরবাসী পালন করে আসছে।