ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের পাদদেশে অবস্থিত চির সবুজে ঘেরা বনানী প্রাচীন জনপদ চাটমোহরের উপজেলার হান্ডিয়াল ।
প্রাকৃতিক বৈচিত্রের নীলাভূমি ,ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের পাদদেশে অবস্থিত চির সবুজে ঘেরা বনানী প্রাচীন জনপদ হল এই হান্ডিয়াল। হিন্দু অধ্যাষিত এই ইউনিয়নে হিন্দু-মোসলমান সহবস্থান করলেও এদের মধ্যে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অত্যান্ত মধুর।
নামকরন হলঃ খিৃষ্টীয় ষোল শতকের শুরু থেকে উনিশ শতকের মাঝামাছি সময় অবদি হান্ডিয়ালে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের রমরমা ব্যবসা ছিল। কথিত আছে , এক সময় হান্ডিয়ালে প্রচুর পরিমনে ’হাঁড়ি’ ব্যাবহার এবং তৈরী করা হত । সেকারনেই প্রথমে এর নাম ছিল ’হাড়িয়াল’ । পরবর্তীতে ইংরেজরা তাদের উচ্চরণের সুবিধার্থে ’হাড়িয়াল’ কে হান্ডিয়াল বলে ডাকত। সেই থেকেই সর্বত্র হান্ডিয়াল হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়ে। হান্ডিয়াল প্রাচীন ঐতিহ্যের সমাহার এবং তাঁর গর্ব করার মত রয়েছে নিজস্ব পুরা কীর্তি । এক সময় এই হান্ডিয়ালে থানা, ইংরেজ নীলকুঠি বাড়ি , গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ মন্দির,জমিদার বাড়ি ছিল। হান্ডিয়াল এতটাই বর্ধিঞ্চু এলাকা ছিল, যেখানে বাজারের এক দালানের (প্রায় ১ কিঃমিঃ ব্যাপী ) ছাদে উঠে সব দালান ঘোরা যেত। ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত হান্ডিয়াল থানা ছিল। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গুমানী , করতোয়া নদী।
প্রমানপত্র ঃ ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দের পর বাংলা বিহার যে আট ভাগে বিভক্তি হয় তার মধ্যে হান্ডিয়াল ছিল হুগলি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত । সংবাদ প্রভাকর ১২৬১ বঙ্গাব্দে ২৮ পৌষ সংখ্যায় উল্লেখ যে, জেলার আটটি থানা – পাবনা , নাজিরগঞ্জ, মথুরা,পাংশা,হান্ডিয়াল , ধর্মপুর , কুষ্টিয়া ও খোকসা।
ঐতিহ্য ও স্মৃতি কথা ঃ কোম্পানী আমলে উন্নত বন্দর হান্ডিয়ালে গড়ে ওঠে রেশন ও তাঁতের কাপড়ের বেচা কেনার কুঁঠি। ওই সময়ে ভারতবর্ষে যত রেশম উৎপন্ন হতো,তার ৪ ভাগের ৩ ভাগই মিলত হান্ডিয়াল বাজারে । ব্রিটিশরা রেশম ও তুলা এখান থেকে ক্রয় করে নিয়ে যেত।
হান্ডিয়ালে আরেক কিংবদন্তি ছিল ’ঘোষ’ পরিবার। এরা এমন ধারার দই তৈরী করতো যে, কলকাতার সাহেব- বাবুরা এখানকার সুস্বাদু মিষ্টি ছাড়া কিছুই বুঝত না। কথিত আছে, ইংরেজরা এই এলকার মিষ্টির জন্য ৭শত’রও বেশি গোয়ালা (ঘোষ) পাালন করত আর তাদের কাজ ছিল নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে সাহেবদের নিকট পাঠানো। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট হান্ডিয়াল এতোটাই গুরুত্ব পায় যে, তারা এখানে বিশেষ পরগণা বানিয়ে কয়েকটি জমিদারকে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রশাসনিক নানা কাজে দায়িত্ব দেয়। ১৭৯০ খৃস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের সময় দশশালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী কালিন পাবনার ভ’-সম্পত্তি নাটোর রাজ রামকৃঞ্চের সাথে বন্দোবস্ত হয়। হ্যামিলটনের লেখা ইন্ডিয়া গেজেটিয়ারে উল্লেখ করেন , হান্ডিয়ালের পাশ্ববর্তী এলাকা বন জঙ্গলে ডাকাতেরা লুকিয়ে থাকত। তাই নৌপথের যাত্রীদের রক্ষাকল্পে ষোল দাঁড়ের একখানা দ্রুতগামী নৌকাসহ জনৈক জমিদার নিযুক্ত করেন। হান্ডিয়ালে তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত ছিলেন। শাহী সুবেদারের অধিনে ছিল মুঘলদের পাঁচ হাজার সেনা,ছিল সেনানীবাস। ইউনিয়নের উন্নয়নের ব্যাপারে সব দল-বল মত নির্বিশেষে সবাই একমত হয়ে একসঙ্গে কাজ করতেন।
এই ইউনিয়নের ঐতিহ্যের রেশমী শাড়িতে বর্নিল হান্ডিয়াল ঃ পীর কামেলের দেশ বাংলাদেশ। হান্ডিয়ালের প্রাচীন নিদর্শন গুলোর দিকে তাকালে হান্ডিয়ালের পশ্চিমে রয়েছে পাকপাড়ায় ওলীয়ে কামেল হযরত শাহ মোখলেছুর রহমান (বুড়ো পীর) সাহেবের পবিত্র মাজার এবং ওরস শরীফ। প্রতিদিন দুর-দুরান্ত থেকে ভক্তবৃন্দ আসেন কবর জিয়ারত করতে। সুদুর আরব জাহান থেকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্যেশে যে ১৭ জন ওলীয়ে কামেলগণের আগমন ঘটে। কথিত / জনশ্রুতি আছে , এদের মধ্যে কেউ কেউ বাঘের পীঠে যেমন হযরত শাহ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) নওগাঁ ,কেহ বা মাছের পিঠে যেমন হযরত শাহ সুলতান মাহী ছয়ার(রহঃ) মহাস্থান,বগুড়া ,কেহ বা উটের পিঠে করে ইসলাম প্রচার করার জন্যে আসেন। সেই ১৭ জনের ১জন হলেন আমাদের হান্ডিয়ালের পাকপাড়ার পূর্ণভূমিতে এসেছিলেন ওলীয়ে কামেল হযরত শাহ মোখলেছুর রহমান (রহঃ)। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনি সূদুর ইরান থেকে এসেছিলেন। যে কয়জন পীরে-কামেল বাংলাদেশে এসেছিলেন তার মধ্যে হযরত শাহ মোখলেছুর রহমান (রহঃ) ছিলেন বয়জেষ্ঠ্য। এজন্যই তাঁকে বুড়ো পীর সাহেব বলা হয়ে থাকে। শোনা যায়, ১২৯২ বঙ্গাব্দে গঙ্গাধর সরকার নামক একজন সরকারী সার্ভেয়ার বুড়োপীরের নিস্কন্টক জমি বাজেয়াপ্ত করতে চাওয়ায় তার রক্তবমি শুরু হয়। শেষে বুড়োপীরের দরগায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করেন।
শেঠের বাংলো ঘর ঃ অনুমান করা হয় সপ্তদশ কিংবা অষ্টদশ শতাব্দীতে এই বাংলা ঘরটি নির্মিত। মতান্তরে ১৭৭৯ বঙ্গাব্দে নির্মিত শেঠের বাংলোঘর ’ এক বাংলা’ বা ’ দু’চালা’ বিশিষ্ট ঘর। ঘরটি আয়তক্ষেত্রের এক খিলান বিশিষ্ট প্রবেশ পথ যুক্ত। এই বাংলা ঘরকে কেন্দ্র করে রয়েছে অনেক কল্প-কাহিনী। লর্ড ক্লাইভ এই ঘরটি জগৎ শেঠকে উপহার দিয়েছিলেন। ঘরটি চুন,সুরকী,পোড়া মাটির তৈরী। ঘরটির গাত্রে রয়েছে বহু প্রাচীন অসংখ্য দূর্লভ নকশা এবং নিপূণ হাতের শৈলিতে ফুটে উঠেছে তার কারুকাজ।
কুঠি বাড়িঃ বাংলাদেশের ভূ’-প্রকৃতির জন্য কোন স্থাপনাই বেশি দিন টিকে থাকে না। ঠিক সেই কারনে পূর্ণাঙ্গভাবে টিকে নেই প্রচীন যুগের কোন স্থাপনা। ফলে প্রাচীন সাহিত্য , শিল্পকর্ম আর পর্যটকদের বিবরণ থেকে সংগ্রহ করতে হয় স্থাপত্য ইতিহাসের রসদ। হান্ডিয়ালের পূর্ব পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ি। তখন এখানে বিরাট আকর্ষনীয় চোখ ধাঁধাঁনো নৌবন্দর ছিল। মাল বোঝাই বিশাল বজরা নৌকা কলকাতা থেকে ঢাকায় যাবার পথে এখানে এসে নঙ্গর ফেলত এবং হান্ডিয়ালের হতিহাস ঐতিহ্য ঘুরে ঘুরে প্রাণভরে উপভোগ করত আর দই মিষ্টি খাওয়ার লোভ নিবারণ করতে না পেরে এখানে সপ্তাহ অব্দি থেকে যেত। একমাত্র এখানেই কোম্পানী আমলের সমস্ত ভারতবর্ষের চার পঞ্চমাংশ রেশম আমদানী হত। এখন কালের পরিবর্তনের ধারায় এই নদীটি মরা নদীতে পরিনত হয়েছে। ধারনা করা হয়, এখানে অনেক বড় বড় রাজ প্রাসাদ ছিল। ১২৯৪ বঙ্গাব্দে প্রলয়ংকারী ভ’মিকম্পে এই জনপদের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। । তবুও এখনো ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে প্রাচীন কৃর্তির ধ্বংসাবশেষ।
নীল চাষ ঃ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হান্ডিয়ালে ব্যাপক হারে নীল চাষ করা হত। বলতে হয় এখানকার কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করা হত। তখন হান্ডিয়ালে ইংরেজ নীল কুঠিদের ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নীল উৎপাদন ও রপ্তানীর ব্যবসা ছিল রমরমা। কিন্তু উনিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে এ বাজার মন্দা হয়ে আসে। কারন জমিদারগণ এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং নীলের জমির উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে রায়তদের লাভ করার আশা নির্মূল করে দিতেন। ফলে চাষিরা নীল চাষে অনাগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। নীলকরদের পীড়ন নীতির ফলে কৃষকরা ১৮৫৯-৬০ সালে বিদ্রোহ করে। অবশ্য ১৮৫৯ সালে যশোর ও নদীয়ায় এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলেন। দ্রুত এ আন্দোলন নীল চাষের আওতাভূক্ত অপরাপর জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় দীন বন্ধু মিত্র রচিত নাটক ’নীল দর্পণ’ এবং কিশোরী চাঁদ মিত্র ও হরিশচন্দ্র মুখার্জীর পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য বিদ্রোহী রায়তদের পক্ষে জন মত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। অবশেষে সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং ১৮৬০ সালে সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করেন। এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর বলপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষনা করে একটি আইন পাশ করা হয়। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে নীল প্রতিরোধ আন্দোলনের অবসান ঘটে। ১৮৬০ সালে সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করেন। এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর বলপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষনা করে একটি আইন পাশ করা হয়। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে নীল প্রতিরোধ আন্দোলনের অবসান ঘটে।