চৈত্রের বৈশাখরে গরমে অতিষ্ঠ মানুষের মধ্যে প্রশান্তি দিচ্ছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সলপের ঘোল। বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে শ্রান্ত মানুষ সলপের এক গ্লাস ঠাণ্ডা ঘোল পান করেই তৃপ্তিলাভ করেন। এতে গরমে ক্লান্তি দূর হয়, শরীরও ভালো থাকে। তাই তো এ গরমে সলপের ঘোলের ব্যাপক চাহিদা।
সলপের ঘোল এখন চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকররা এসে এ ঘোল নিয়ে বিক্রি করছেন। ফলে এখানকার ঘোল ব্যবসায়ীদেরও পসার অনেক বেড়ে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সলপ রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বপাশে আবুল কাশেম খানের বিশাল ঘোল কারখানায় বিরামহীন কাজ করছেন শ্রমিকরা। কারখানার পাশেই দোকানে পাইকারি ও খুচরা ঘোল বিক্রি চলছে। স্টেশনের পশ্চিম পাশে আব্দুল মালেক ও আব্দুল খালেকের দুটি বিশাল কারখানায় ঘোল উৎপাদন চলছে। এদের দোকানে দেখা যায় গ্রাহকের ভিড়। এরা ছাড়াও সলপ স্টেশন এলাকায় অন্তত ২০/২৫টি ছোটবড় ঘোলের কারখানা ও দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানেই রয়েছে ক্রেতাদের ভিড়। প্রতিটি দোকানে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ থেকে দুইশ মণ ঘোল বিক্রি হয়। এ গরমের মৌসুমে কোটি টাকার ঘোল কেনাবেচা হবে বলে উৎপাদনকারীরা জানান।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও ঘোল উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় একশ বছর আগে থেকে সলপ এলাকায় ঘোল তৈরি হয়। তখন সাদেক আলী নামে এক ব্যক্তি ঘোল ও মাঠা তৈরি করে সলপ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। সুস্বাদু পানীয় হওয়ায় ঘোলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। সাদেক আলীর ঘোলের ব্যবসাও বাড়তে থাকে। পরে স্টেশনের পাশে ঘোলের দোকান করেন তিনি। সারা বছরই এ ঘোলের ক্রেতা আসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। গরমের সময় এ ঘোলের চাহিদা থাকে বেশি। বিশেষ করে রমজান মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে চাহিদা অনেক বেড়ে যায়।
কথা হয় নওগাঁ থেকে ঘোল কিনতে আসা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সলপের ঘোল সব মানুষই খায়, প্রচুর চলে আমাদের এলাকায়। ঘোল নিয়ে বিক্রি করে ভালো পয়সা পাই।
সলঙ্গা থেকে আসা জাকারিয়া বলেন, বিভিন্ন জায়গায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোল হিসেবে সলপের ঘোলের সুনাম আছে। সবাই সলপের ঘোল চায়-এ জন্য আমরা এখান থেকে ঘোল নিয়ে যাই।
এনায়েতপুরের এক পাইকারি ঘোল ক্রেতা বলেন, প্রথমে অল্প ঘোল নিয়ে বিক্রি করি। এটা খেতে খুব সুস্বাদু। মানুষ খেয়ে বলে অনেক ভালো। সলপের নাম এ কারণে দেশের আনাচে কানাচে চলে গেছে।
পাবনা জেলার কাশিনাথপুর থেকে আসা মামুনুর রশিদ ও শরিফুল বলেন, বিভিন্ন লোকের মুখে প্রশংসা শুনে আজ ঘোল নিতে এসেছি।
ঘোল তৈরি প্রসঙ্গে এক কারিগর বলেন, গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর দুধটা ঘন হয়ে গেলে পাতিলে নামিয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য রেখে দিই। সেই দুধ জমে দই হয়ে গেলে ওপর থেকে সর সরিয়ে ফেলা হয়। তাতে চিনি ও অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু ঘোল।
আবুল কাশেম খান ঘোল ঘরের ম্যানেজার মো. হাসেম আলী বলেন, প্রতিদিন খামারিদের কাছ থেকে তিনশ/চারশ মণ দুধ সংগ্রহ করি। এ থেকে যে ঘোল তৈরি হয়, তা প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে যায়। প্রতি কেজি ঘোল একশ টাকা করে বিক্রি করা হয়। দুধের দাম বেশি হওয়ায় ঘোলের দামও বেশি নিতে হচ্ছে।
ঘোল উৎপাদনকারী হাফিজুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের ব্যবসাটা তিন পুরুষ ধরে করছি। আগে স্বল্প পরিসরে হলেও এখন সারা দেশে এ ঘোল চলছে। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল বিভাগেও এ ঘোল চলে যাচ্ছে।
ঘোল উৎপাদনকারীদের একজন আব্দুল মালেক খান, তিনি বলেন, ১৯২২ সালে আমার দাদা এ অঞ্চলে ঘোলের ব্যবসা শুরু করেন। কালের বিবর্তনে এ অঞ্চলের ঘোষ সম্প্রদায় চলে যাওয়ার পর আমার দাদাই ঘোলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন। পরে আমার বাবা-চাচারা শুরু করেন। তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে আমরা দাদার ঐতিহ্য ঘোল ও মাঠা তৈরির ব্যবসা ধরে রেখেছি। এখন অনেক দোকান বেড়ে গেছে-বেচাকেনাও বেড়েছে। রোজার মাসে ঘোলের চাহিদা বেশি থাকে। বিকেল ৩টার মধ্যেই আমার সব ঘোল বিক্রি হয়ে যায়।