দূর থেকে মনে হয় যেন মাঠের একটি বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হলুদ চাদরে ঢাকা। এমন নয়নাভিরাম সরিষা ফুলের দৃশ্য, ফুলের মৌ মৌ গন্ধ, আর মৌমাছির গুঞ্জন মনকে বিমোহিত করে। এ দৃশ্য দেখে দুচোখ ফিরিয়ে নেওয়া হয়ে পড়ে কষ্টসাধ্য।
এদিকে, অন্যান্য ফসলের চেয়ে ভালেঅ দাম পাওয়ায় এবার সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা। কুয়াশা উপেক্ষা করে ক্ষেত পরিচর্যা করছেন চাষিরা। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ৮৭ হাজার ২৩৯ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। গত বছর জেলায় ৬৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল। গত বারের চেয়ে এ বছর ২৩ হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। গত বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৩ হাজার ৯৮০ টন। এ বছর আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮৬০ মেট্টিক টন। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে সব চেয়ে বেশি উল্লাপাড়া উপজেলায় এবার সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৬শ’ ১১ হেক্টর।’
কৃষি বিভাগ থেকে ১ কেজি বীজ ও বিভিন্ন ধরনের ৩০ কেজি করে প্রণোদনা হিসেবে ৪১ হাজার ২০০ কৃষক কৃষকে সার দেওয়া হয়েছে। এবার বারি-১৪, বারি-১৭, বারি-৯১ ও বিনা ৪ ও ৯ জাতের উন্নত মানের সরিষা আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। উন্নত জাতের সরিষা আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করণ, প্রণোদনা দেয়ায় এবং কৃষক লাভবান হওয়ায় জেলায় সরিষার আবাদ প্রতি বছরই বাড়ছে। জেলায় গত বছরে ৪০ হাজার লিটার সরিষার তেল উৎপাদন হয়েছিলো। এবছর ৫৫ হাজার ৬১৬ লিটার সরিষা তেল উৎপাদন হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। ফলে দেশে ভোজ্যতেলের ঘাটতি অনেকটা মিটবে বলে মনে করেন তারা।
জানা যায়, কম সময় ও স্বল্প খরচের বিপরীতে লাভ বেশি হওয়ায় সরিষা উৎপাদনে ঝুঁকেছেন কৃষকেরা। প্রতি বছরই ভালো ফলনের আসায় সরিষার চাষের পরিমাণও বাড়ছে। সরকারি প্রণোদনা ও অনুকুল আবহাওয়া থাকায় এবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে সরিষা চাষ করেছেন কৃষক। দানাদার শস্যটির চাষ বাড়লে দেশে ভোজ্যতেলের ঘাটতি অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের সরিষা চাষী আবুল হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরে সরিষা চাষ করি। প্রতি বিঘায় ছয়-সাত মণ হারে ফলন আসে। দামও ভালো পাওয়া যায়। এ বছর এক বিঘা জমিতে বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করেছি। সরিষা তোলা শেষ হলে এ জমিতে বোরো ধান লাগানো হবে।
সদর উপজেলার ছোনগাছা গ্রামের সরিষা চাষী আব্দুল হাই বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে সরিষার আবাদ করি। গত বছর ৮ বিঘা জমিতে টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করতাম। ফলন হতো প্রতি বিঘায় তিন-চার মণ। কিন্তু চার বছর ধরে উন্নত বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করে বিঘাপ্রতি সাত-আট মণ ফলন পাচ্ছি। আর লাভবান হওয়ায় এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে উন্নত বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করছেন। ফলনও ভালো দেখা যাচ্ছে।
উল্লাপাড়ার কয়ড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, জমিতে থেকে দ্রুত পানি নেমে যাওয়ায় ও আবহাওয়া ভালো থাকায় আমি ৫ বিঘা সরিষার আবাদ করেছি। অনেক সুন্দর আবাদ হয়েছে, ভালো ফলন হবে আশা করছি।
কৃষকেরা জানায়, এক বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে (হাল, বীজ, সার) খরচ হয় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। এক বিঘা জমিতে ৭ থেকে ৮ মণ সরিষা পাওয়া যায়। প্রতি মণ দাম দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ টাকা। আর বিঘায় খরচ বাদে লাভের পাশাপাশি নিজেদের তেলের চাহিদাও পূরণ হয়। আবহাওয়া ভাল থাকলে সময় মতো সরিষা ঘরে তুলতে পারবে। এ বছরের মতো আগামীতে ভালো দাম পাবেন বলে তাদের আশা।
আদর্শ মৌ খামারের মালিক শহিদুল ইসলাম জানান, আবার ৩ শতাধিক মৌ বাক্স বসানো হয়েছে। এতে প্রতি সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ মণ মধু সংগ্রহ করা যায়। সরিষার ক্ষেতে মৌ বাক্স বসানোর কারণে সরিষার ফলনও বাড়ে। খাঁটি মধু কিনতে অনেকেই মাঠে আসছেন।
মৌ চাষি আশরাফুল ইসলাম জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করতে এসেছে পাইকারি ব্যাবসায়ীরা। ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা উন্নতমানের মধু পাইকারি ২৫০-৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে মধু সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় কাঙ্খিত দাম পাওয়া যায় না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (উপ-পরিচালক) বাবলু কুমার সুত্রধর জানান, জেলার ৯টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ৮৭ হাজার ২৩৯ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বারের চেয়ে এ বছর ২৩ হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে বেশি সরিষার চাষ হয়েছে। সরকারের ভোজ্য তেলের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আমরা সরিষার চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছি। শুধু সরিষাই নয় জেলায় গত বছর ৩শ’ মেট্টিক টন মধু আহরণ করা হয়েছিলো। এবছর প্রায় ৪শ’ মেট্টিক টন মধু আহরণ হবে।
তিনি আরও জানান, ফসলের মাঠে মৌমাছির এই মধু সংগ্রহের ফলে সরিষার ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল থেকে অন্তত ৭শ’ মেট্টিক টন মধু আহরণ করা হবে। যার কারণে বিদেশ থেকে সয়াবিন তেল ও মধু আমাদানি কমে আসছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক সাশ্রয় হচ্ছে। একই সঙ্গে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।