হাওরপাড়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ গ্রাম সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া। ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ি, তিনগম্বুজ মসজিদ, বিশালাকার দিঘিকে ঘিরে রয়েছে নানা কল্পকাহিনি। তিনশত বছরের বেশি পুরনো এই ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ি দিঘির পাড়ে বসে স্ত্রীর বিরহে গান লিখেছিলেন মরমি কবি হাসন রাজা। ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ির জৌলুশ আর প্রভাব প্রতিপত্তিতে নিজের আক্ষেপ জানিয়ে দিঘির পাকা ঘাটে বসে লিখেছিলেন ‘লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি ভালা না আমার’ এই গান। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারকবাহক দৃষ্টিনন্দন দিঘিটি আজও সাক্ষ্য বহন করছে ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ি ও তার সানশওকতের।
জানা যায়, ১৭ দশকের প্রথম দিকে ভাটিপাড়া জমিদারবাড়ির জমিদারি গোড়াপত্তন হয়। জমিদারি আমলের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠাতা জমিদার মোহাম্মদ আলী খুরাইশী পাত্তাহ প্রজাসাধারণের পানির চাহিদা মেটাতে জনহিতকর কাজ হিসেবে খরস্রোতা পিয়ানদীর খালের দুই পাশে বাঁধ দিয়ে প্রায় ১০ বিঘা জমির ওপর দিঘিটি খনন করেন তিনি। সুপেয় পানি সংগ্রহে নদীর তলদেশের চেয়ে বেশি গভীর করা হয়েছিল দিঘিটি।
দিঘির খননকৃত মাটি দিয়ে চারপাশে বসতি স্থাপন করা হয়েছি। দিঘির পূর্বপাশে জমিদারবাড়ির একাধিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। ইট আর পোড়ামাটির এই বাড়িগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই দিঘি ছাড়াও জমিদার বাড়ির দুই পাশে আরও দুইটি দিঘি খনন করা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় যা ভরাট হয়ে গেছে। দিঘির পূর্ব-উত্তর পাশে নির্মাণ করা হয় তিন গুম্বুজওয়ালা বিশাল মসজিদ, যা দিঘির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। কোনো ধরনের পাথর আর রডের ব্যবহার ছাড়াই কেবল ইট আর চুনাপাথরের আস্তরণ দিয়ে দিল্লি জামে মসজিদের আদলে ১৭ দশকের শেষের দিকে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
কথিত রয়েছে তিন গম্বুজের এই মসজিদটি নির্মাণ করতে নদীর পাড়ে তিনটি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছিল। যেখানে সনাতন পদ্ধতি ইট তৈরি করে মসজিদের গায়ে স্থাপন করা হতো। মসজিদে যে পাথরের আস্তরণ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা ভারত থেকে হাতির পিঠে করে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে জানা যায়।
দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ নির্মাণ করতে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ বছর সময় লেগেছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আয়তাকার দৃষ্টিনন্দন দিঘি ও দৃষ্টিনন্দন মসজিদের ইতিহাসের দৃশ্যপট একই সুতোয় গাঁথা। দিঘিতে একসময় পাঁচটি পাকা ঘাটের অস্থিত্ব ছিল। পাঁচটি ঘাটের আলাদা আলাদা নাম ছিল। সবচেয়ে বড় ঘাটটি মুসল্লিদের ওজু-গোসলের জন্য ব্যবহার হতো। দুটি ঘাট সাহেববাড়ির অভিজাত শ্রেণির লোকেরা ব্যবহার করতেন। পূর্ব পাড়ে দুটি ঘাট জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল বলে জানা যায়। দিঘির পাড়ে বসে অবসর সময় কাটাতেন জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা।
ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রীর জমিদার দেওয়ান হাসন রাজার। হাসন রাজার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ভাটিপাড়া জমিদার মোহাম্মদ আলী কোরাইশীর বংশধর। মরমি সাধক হাসন প্রায়ই বজ্রায় করে আসতেন শ্বশুরবাড়ি। দিঘির পাড়ে বসে প্রভুর স্মরণে লিখতেন গান। তার কালজীয় গান ‘লোকে বল বলেরে ঘর বাড়ি ভালা না আমার’ এই গানটি দিঘির পাড়ে বস লিখেছিলেন তিনি। ইতিহাস ঐতিহ্যের সমৃদ্ধপূর্ণ ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ি, দৃষ্টিনন্দন, দিঘি ও মসজিদ দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
এদিকে সময়ের ব্যবধানে পৃষ্টপোষকতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জৌলুশ হারাচ্ছে ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ির ঐতিহাসিক স্থাপনাশৈলী ও দিঘিটি। ময়লা-আবর্জনা ও কচুরিপানার কারণে হাজামজা পুকুরে রূপ নিয়েছে দিঘি এলাকা। সঠিক তদারকি ও পৃষ্টপোষকতা করলে এর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
ভাটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সইদুর তালুকদার বলেন, ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ির ইতিহাস অনেক পুরনো। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জমিদারি ছিল এটি। লাউড়ের পাহাড় থেকে বিশাল এলাকাজুড়ে জমিদারিত্ব ছিল। জেলার একমাত্র জমিদার বাড়ি যার স্থাপনাগুলো এখনো দৃশ্যমান রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও বিশাল দিঘি ঘিরে এই এলাকায় অনেক কল্পকাহিনি রয়েছে। এখন যারা বসবাস করছেন তারা ২৪তম বংশধর। তবে কেউই এখানে থাকেন না। দেশে এবং দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাদের বংশধরেরা। ফলে অযত্ন-অবহেলায় জমিদারবাড়ির অনেক স্থাপনা পড়ে রয়েছে। এইগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কথা হয় ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ির বংশধর এম এইচ পাবেল চৌধুরীর সাথে। তিনি জানান, জমিদারবাড়ির প্রায় সবাই-ই বাইরে অবস্থান করছেন। তিনিও যুক্তরাজ্য অবস্থান করেন। এবার দেশে এসে জমিদারবাড়ির স্মৃতি রক্ষায় কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলেন তিনি।
পাবেল চৌধুরী বলেন, আমরা বাইরে অবস্থান করলেও এলাকার জন্য মমত্ববোধ রয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জমিদারবাড়ির মসজিদটি পরিচালনা করা হয়। একাধিকবার এর সংস্কার করা হয়েছে। দেশে এসে দিঘিটির ময়লা পরিষ্কার করেছি। জমিদারবাড়ির স্থাপনাগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একটি মিউজিয়ামের কথা চিন্তা করছি আমরা। যেখানে জমিদার বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন রাখা হবে। জমিদারবাড়ি, মসজিদ ও দিঘি ঘিরে এখানে পর্যটন সম্ভবনা বাড়ানো সম্ভব। তবে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তিনি।