মামুন হোসেন, পাবনা: পাবনা চাটমোহর উপজেলার দিঘুলিয়া গ্রামের আব্দুর রশিদ সাত বছর ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। প্রবাসি আব্দুর রশিদের স্ত্রী লাবনী খাতুন তার বাড়ী নির্মাণের জন্য কয়েক দিন আগে প্রায় ২৫ হাজার ইট ক্রয় করে ও ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলন করে বাড়িতে রাখে। লাবনী খাতুনসহ তার ১০ বছরের ছেলে রিয়াদ গত ২৫ জানুয়ারি রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে যায়। পরের দিন সকালে ঘরের দরজা খোলা এবং আসবাব পত্র এলোমেলো দেখে আত্মীয়স্বজন তাদের খোঁজাখুজি শুরু করে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে লাবনীর মৃতদেহ ছাগল রাখার ঘরে এবং ১০ বছরের ছেলে রিয়াদের মৃতদেহ বাড়ির পাশে পুকুর পারে গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের পর চাটমোহর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পরে পাবনা পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুনসীর নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) মো. মাসুদ আলম এর তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে, ওসি ডিবি মো. এমরান মাহমুদ তুহিন, এসআই (নিরস্ত্র) বেনু রায়, মো. রিমন হোসেন পিপিএম জেলা গোয়েন্দা শাখাসহ সঙ্গীয় অফিসার ফোর্স ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (নি:) মো. গোলাম রসুল হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদ্ধঘাটন ও চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে তথ্য প্রযুক্তি ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে নৃশংস হত্যাকান্ডে জড়িত ৩ জন অভিযুক্ত আসামী চাটমোহর ধুপুলিয়া এলাকার মোজাম আলী ওরফে মোজাম্মেলের দুই ছেলে মো. সাদ্দাম হোসেন (২৬) ও মো. হোসেন আলী (৩৭), রাজবাড়ী খানখানাপুর দত্তপাড়া এলাকার মো. মোস্তফা মিজীর ছেলে মো. হুমায়ন মিজী ওরফে হৃদয় (২৮) কে গ্রেফতারসহ মালামাল উদ্ধার করে পাবনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
বৃহস্পতিবার সকালে পাবনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন পাবনা পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুনসী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, হোসেন আলী ও লাবনী খাতুন একই গ্রামে বসবাস করেন। হোসেন আলী লক্ষ্য করেন লাবনী খাতুন বাড়ি নির্মাণের জন্য ইট নিয়ে এসেছে এবং ঘটনার ২ দিন আগে লাবনী চাটমোহর ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়েছে। হোসেন আলী ধারণা করেন প্রবাসীর স্ত্রী লাবনীর কাছে মোটা অংকের টাকা ও স্বর্ণালংকার আছে। এই খবরটি সে তার আপন ছোট ভাই সাদ্দাম কে জানায়। সাদ্দামের বাড়ি চাটমোহর দিঘুলিয়া গ্রামে হলেও সে দীর্ঘদিন যাবত শ্বশুর বাড়ি গোপালগঞ্জে বসবাস করে এবং সে পেশায় একজন চোর ও ছিনতাইকারী।
নগদ টাকার খবর পাওয়ার পরে ফরিদপুর থেকে আরেক চোর হুমায়ুন কবির হৃদয়কে সাথে নিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি সকালে ফরিদপুর থেকে পাবনার উদ্দেশ্য রওনা হয় তারা। পরে সাদ্দাম ও হৃদয় টেবুনিয়াতে অবস্থান করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হোসেন আলী লাবনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে থাকে। রাত গভীর হলে হোসেন আলী ভাই সাদ্দাম ও হৃদয়কে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসে। তারপর আনুমানিক রাত ১ টার দিকে অভিযুক্ত আসামী সাদ্দাম ও হৃদয় গাছ বেয়ে লাবনীর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে। বাহিরে মেইন দরজা খুলে রেখে ঘরের পিছনে টিন কেটে ঢোকার চেষ্টা করলে লাবণীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে কিসের শব্দ ছিল জানার জন্য ঘরের দরজা খুলতেই
ঘাতকেরা তাকে ধরে ফেলে এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে। পরে ১০ বছরের শিশু রিয়াদ ঘুম থেকে উঠে ভয়ে চিৎকার শুরু করলে সাদ্দাম রিয়াদকে পুকুর পাড়ে নিয়ে মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করে। পরে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য রিয়াদের লাশ তারা গাছে ঝুঁলিয়ে রাখে। পরবর্তীতে সাদ্দাম এবং হৃদয় মিলে পুনরায় প্রবাসীর বাড়ীতে এসে লাবনী খাতুনের কোমড়ে থাকা চাবি ও কানে থাকা স্বর্ণের রিং নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকে স্টিলের ট্রাংক থেকে স্বর্ণের চেইন, হাতের বালা, কানের দুল, দুইজোড়া রুপার নুপুর, রুপার পায়েল নিয়ে বাড়ীর পিছন দিক দিয়ে হোসেনের বাড়ীর পিছনে লিচু বাগানে যায়। তারা হোসেনের সাথে দেখা করে লাবণীর কানে থাকা স্বণের রিং হোসেনকে দিয়ে আনুমানিক রাত ৩ টার দিকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এভাবেই মাত্র কিছু স্বর্ণ ও টাকার লোভে মা ও শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পালিয়ে যায় হত্যাকারিরা।
পুলিশ সুপার জানান, সাদ্দাম হোসেন ২০২২ সালের অক্টোবরে চাটমোহর ফৈলযানা এলাকায় সিএনজি ড্রাইভার (ইসমাইল) কে শ্বাধরোধে হত্যা করে সিএনজি ছিনতাইয়ের ঘটনার মূল আসামী ছিল। এ মামলায় সে দীর্ঘদিন যাবত পলাতক ছিল। এছাড়াও সাদ্দামের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অপর আসামীদের বিরুদ্ধে চুরি, দসুত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশ সুপার জানান, তাদের কাছ থেকে একটি স্বর্ণের চেইন (১২ আনা), একজোড়া হাতের বালা, একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল (৬ আনা), একজোড়া স্বর্ণের কানের রিং, দুই জোড়া রুপার নুপুর (৮ ভরি) একটি রুপার পায়েল, নগদ ৩০,০০০ হাজার টাকা, আসামীদের ব্যবহৃত ০৩ টি মোবাইল ফোন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত টিন কাটার কেচি এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত মাফলার ও ওড়না উদ্ধার করা হয়।