দাম কমে যাওয়ায় সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষিরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি উৎপাদনকারী জেলা বাগেরহাটে গলদা চিংড়ি কেজিতে ৩ থেকে ৫’শ টাকা পর্যন্ত দাম কমে গেছে। বর্তমানে চিংড়ি উৎপাদনের ভরা মৌসুম। অপরদিকে মাছের খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে।
এ জেলার কয়েক লাখ গলদা চিংড়ি চাষি বিপাকে পড়েছেন। বৈশি্বক মন্দার অজুহাতে মধ্যসত্বভোগীদের কারসাজিতে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চাষিরা।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং, খরা ও ভাইরাসে মড়ক-সহ নানা নানা প্রতিকূলতার পর এখন এ দরপতন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে চিংড়ি চাষিদের জন্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশপাপাশি বৈশ্বিক সংকট এবং মহামারি করোনায় রপ্তানি কমে যাওয়ায় চিংড়ি শিল্পে মন্ধা দেখা দিয়েছে বলে রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন। তাই লোকসানে পড়া চিংড়ি চাষিরা এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করছেন।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি সুমন ফকির জানান, দেশের মোট চিংড়ির বেশির ভাগই খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে উৎপাদিত হয়। তবে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ৮০ শতাংশ চিংড়ি উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ উৎগাদিত হয় বাগেরহাঠে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাট জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। ১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৩ হাজার টন গলদা বাগদা উৎপাদন হয়েছে, এই বছর রপ্তানি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৩০ টন। পরের বছর ১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৩৮ টন, রপ্তানি হয় ২৪ হাজার ৪১৩ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৯৪২ টন। যা থেকে রপ্তানি হয়েছিল ২৩ হাজার ৬৮ টন। ২০-২১ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৮৫৮ টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে এ জেলায়। রফতানি হয়েছে ২৩ হাজার ৩৬৭ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩৯ হাজার ৮৭৮ টন। এ বছর রপ্তানি হয়েছে ২৪ হাজার ১০৪ টন।
সরেজমিনে বাজার ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে ‘ফিস ফিড’ বা মাছের খাবারের দাম খুব চড়া। এক বছর আগে ৩৫ কেজি ভুসি ১ হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হলেও, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২ হাজার টাকা, ডাল ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা বর্তমানে ২ হাজার ৮০০ টাকা, প্রক্রিয়াকরণ খাবার ফিশ ফিড কোম্পানি ভেদে ২৫ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
এদিকে চিংড়ি মাছের দাম কমেছে। অপরদিকে আকারভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মূল্য কমেছে প্রতি কেজি চিংড়ির। এক বছর আগে যে চিংড়ির কেজি ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা ছিল, বর্তমানে তা ৮০০ টাকা, আবার যা ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬’শ থেকে ৭০০ টাকা দরে। ৯’শ টাকার চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকায়।
ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের রাজপাট গ্রামের চিংড়ি চাষী ইউনুস আলী সেখ বলেন, ‘প্রায় ২৬ বছর ধরে চিংড়ি ও সাদা মাছের চাষ করছি। নানা প্রকৃতিক দুর্যোগ এবং ভাইরাসে মড়কের কারণে কোন কোন সময় লোকসান হয়েছে। কিন্তু এবারের মত হয়নি।
একদিকে খাবারের (ফিস ফিড) দাম খুব বেশি, অন্যদিকে ভর মৌসুমে মাছের দাম খুব কম। ফলে বিপদে পড়েছি। গত বছর ১’শ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করে ১৫ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এবার চরম লোকসান হবে বলে শঙ্কা করছি।’’ অনুরূপ হাপিত্যেশ করেন জামাল হায়দার, রমেশ গোলদার, কামাল মোল্লা, শেখর ভক্ত-সহ অসংখ্য চিংড়ি চাষি।
মেসার্স পদ্মা মৎস্য আড়তের মালিক ওমর আলী বলেন, প্রকৃতপক্ষে চিংড়ি ব্যবসায় একটি অসাধু সিন্ডিকেট রয়েছে। যাদের কারসাজির কারণে ভরা মৌসুমে চিংড়ি চাষীরা মাছ বিক্রির সময় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষি। এই মধ্যসত্ত্বভোগী সিন্ডিকেট ছাড়া যদি সরাসরি কোম্পানিতে মাছ বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে চিংড়ি চাষিরা লাভবান হতেন। তিনি চাষিদের কাছ থেকে সরারসরি কোম্পানিগুলো মাছ বিক্রির ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
ফকিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপন দাশ বলেন, বাগেরহাট চিংড়ি চাষের জন্য বিখ্যাত। এখানে হাজার হাজার মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে নির্ভরশীল। যে কোন প্রকার মধ্যসত্বভোগীদের কারণে চাষি ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। যা চিংড়ি শিল্পের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। এ ব্যাপারে সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জররী বলে মনে করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ.এস.এম রাসেল বলেন, বৈশ্বিক মন্দা, করোনাসহ নানা কারণে চাষীরা একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার পরও বাগেরহাটে চিংড়ি উৎপাদন কমেনি। তবে অপেক্ষাকৃত দাম কম হওয়ায় চাষীরা এখন কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। আশা করছি, এ সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে।