দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বাতিল ও বিরোধী নেতাকর্মীদের মুক্তির আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন ১৪১ জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
বুধবার (২২ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলেন, ‘দেশের জনগণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দাবি উপেক্ষা করে সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগের পরামর্শ ও নির্দেশনা মোতাবেক আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেশ ও জাতিকে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের একতরফা নির্বাচন আয়োজনে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
কর্মকর্তারা বলেন, ‘সরকার জন-আকাঙ্ক্ষা, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, এমিক্যাসকিউরিদের বিশেষজ্ঞ মতামত, এমনকি নিজ দলের সংসদীয় কমিটির মূল সুপারিশ উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সনে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে মীমাংসিত ও নন্দিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ২০১১ সনে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সনে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনে জনগণ আর ভোট দিতে পারেনি। বিশেষ করে ২০০৮-এর পর নতুনভাবে ভোটার হওয়া কোটি কোটি যুবক ভোটার এ পর্যন্ত একবারের জন্যও ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে নজিরবিহীনভাবে ১৫৩ জন সংসদ সদস্যকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করিয়ে নেওয়া হয়। আলোচনার মাধ্যমে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও ২০১৮ সনের নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত হয়।
নির্বাচনের আগের দিন মধ্যরাতে ভোট হয়ে যাওয়ার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে।
তারা বলেন, দেখা যায় বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরাই বিজয়ী হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। সরকার ক্ষমতা হারানোর ভয়েই আদালতের রায়ের অজুহাত দেখিয়ে প্রতারণামূলকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করেছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনসহ কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগেও তার পছন্দের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
ইতোমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে দলীয় সরকারের ইচ্ছামতো ঢেলে সাজানো হয়েছে। এমন বাস্তবতায় দেশের জনগণ, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রত্যাশিত অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব নয়।
অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তারা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি সরকার ২০১৪ ও ২০১৮-এর ন্যায় আরও একটি একতরফা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একের পর এক বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। ২৮ অক্টোবর পরবর্তী বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য গায়েবি মামলা দায়ের এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মৃত, গুম, বিদেশে অবস্থানরত, ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীণ ব্যক্তিদেরও নতুন মিথ্যা মামলায় আসামি করা হচ্ছে। এমনকি মৃত ও গুমের শিকার অনেক নেতাকর্মীদের সাজানো মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে।
আইন বহির্ভূতভাবে পিতার পরিবর্তে পুত্রকে, পুত্রের পরিবর্তে পিতাকে, ভাইয়ের বদলে অন্যভাই বা আত্মীয়-স্বজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রাতের অন্ধকারে মুখোশধারী লোকজন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে বিরোধী দলের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করে চলেছে সরকার।
তারা বলেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে আন্তর্জাতিক মহল কর্তৃক বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছে সরকার। এহেন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন সরকারের একতরফা নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
এ দেশের ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সংবিধানের বাইরে গিয়েও বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। কারণ, নিকট অতীতে অর্থাৎ ১৯৯১ সাল এবং ২০০৮ সালে সংবিধানের বাইরে যেয়ে এ কাজটি করার নজির রয়েছে। ১৯৯১ সালে ঘটনাত্তোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
সে সময় doctrine of necessity প্রয়োগ করে সংবিধানের বাইরে গিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে ফেরৎ যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় যা পরবর্তী সংসদে ঘটনাত্তোর অনুমোদন (ratification) এর মাধ্যমে সংবিধানসম্মত করা হয়। ২০০৭-০৮ সালের সেনা সমর্থিত জরুরী সরকার ৯০ দিনের স্থলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত প্রায় ২ বছরকাল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন পরিচালনা করেন। উক্ত অতিরিক্ত মেয়াদকালকে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ বাতিল করে প্রদত্ত রায়ে বা আদেশে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক মার্জনা করা হয়। রায়ে বলা হয়, ২০০৭ সালের দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বছরের সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা (Condone) করা হইলো। মোদ্দাকথা রাজনৈতিক সমঝোতা হলে প্রয়োজনে doctrine of necessity প্রয়োগ করে যেকোন প্রতিবন্ধকতাই সফলভাবে কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
তারা বলেন, আরও একটি বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। দেশের ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগকে উপেক্ষা করে আরও একটি একতরফা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে অগ্রসর হলে এর সকল দায়-দায়িত্ব মূলত সরকারকে বহন করতে হবে বলে আমরা মনে করি।
তারা বলেন, আমাদের সংবিধানের মূল চেতনাই হচ্ছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় নিয়ামক। বর্তমানে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খুঁজে বের করার জন্য আমরা ঘোষিত তফসিল বাতিল করার আহবান জানাচ্ছি। এ লক্ষ্যে আমরা অবিলম্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে একটি সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাগণের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ১. এ এস এম আব্দুল হালিম, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, ২. মো. আবদুল কাউয়ুম, সাবেক সচিব, আইজিপি, ৩. মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাবেক সচিব, ৪. সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব, ৫. মো. আব্দুর রশীদ সরকার, সাবেক সচিব, ৬. আবু মো. মনিরুজ্জামান খান, সাবেক সচিব, ৭. এ এম এম নাছির উদ্দিন, সাবেক সচিব, ৮. মো. মনিরুল ইসলাম, সাবেক সচিব, ৯. মো. শরফুল আলম, সাবেক সচিব, ১০. এম সিরাজ উদ্দিন, সাবেক যুগ্ম সচিব, ১১. ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, ইসি, ১২. মকসুমুল হাকিম চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, ১৩. মো. আবদুজ জাহের, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, ১৪. আফতাব হাসান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, ১৫. মো. আজিজুল ইসলাম, ১৬. ইকতেদার আহমেদ, সাবেক জেলা দায়রা জজ ও রেজিস্টার জেনারেল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ১৭. মো. মনসুর আলম, ১৮. এ কে এম মাহফুজুল হক, ১৯. শেখ মো. সাজ্জাদ আলী, ২০. মো. মেজবাহুন্নবী, ২১. বাহারুল আলম, ২২. মোহাম্মদ মাজেদুল হক, ২৩. মো. খান সাঈদ হাসান, ২৪. মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, ২৫. মোহা. আবুল কালাম আজাদ, ২৬. এম. আকবর আলী, ২৭. ডা. এ জেড এম জাহীদ হোসেন, ২৮. বিজন কান্তি সরকার, ২৯. এ বি এম আব্দুস সাত্তার, ৩০. তপন চন্দ্র মজুমদারসহ আরও ১১১ জন।