২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত চলছে স্বাধীনতাকামী জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর স্বশস্ত্র বাহিনীর। সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকট সামাল দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে এখন জান্তা সরকার। আভাস পাওয়া যাচ্ছে ক্ষমতার রদবদলের। ফলে অনেকেই মনে করছেন, জান্তা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় আসছে প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সামনে। ভারমুক্ত হওয়ার সুযোগ আসছে বাংলাদেশের সামনেও।
তবে, শুধুমাত্র জান্তা সরকারের পতন হলেই কি নিজভূমে ফিরে যেতে পারবেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা? আরাকান আর্মি কি আসলেই ভরসাযোগ্য? কিংবা অং সান সুচি মুক্তি পেলে সুগম হবে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পথ?
স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলমান থাকলেও,
গত বছরের অক্টোবরে হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলেও খবর প্রকাশ হয়েছে।
মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল ‘স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই মূহুর্তে দেশটির জান্তা সরকারের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের উপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড।
থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।
সর্বশেষ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেরও দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি। জানুয়ারির শেষ দিকে এসে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করে যুদ্ধ-পরিস্থিতি। আরাকান আর্মির হামলায় পর্যুদস্ত হয়ে চলতি মাসের ৪ তারিখ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সশস্ত্র সদস্যরাও। এর আগে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে চীন ও ভারতে পালিয়েছে। যুদ্ধ না করেই আত্মসমর্পণ করেছে জান্তা সমর্থিত হাজার হাজার সৈন্য।
অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত ত্রিশ হাজারের মতো সেনা হারিয়েছে জান্তা সরকার। যেখানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে সেনার সংখ্যা মাত্র দেড় লাখ।
মিয়ানমারে প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে সামরিক বাহিনী এবং দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। সব দিক দিয়েই এখন কোণঠাসা জান্তা সরকার। একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দেশটির সেনা সরকার। নিশ্চিত তথ্য পাওয়া না গেলেও, বলা হচ্ছে আরাকানের বেশির এলাকাই এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
এমন অবস্থায় দ্রুতই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে জান্তা সরকার। এরপরও নিজভূমে ফেরার স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছেন না বাংলাদেশের শরণার্থী রোহিঙ্গারা। আরাকান আর্মি সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকেই স্বীকৃতি দেয়ার কথা বললেও বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা। বলছেন, এখন যে আরাকান বাহিনী জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে, রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের পেছনে তাদেরও ভূমিকা ছিলো।
রোহিঙ্গা নেতা ও সাধারণেরা বলছেন, আরাকান আর্মির বেশিরভাগ সদস্যই রাখাইন জাতি গোষ্ঠীর সদস্য। আর এ রাখাইনরাই রোহিঙ্গাদের বেশি নির্যাতন করেছিলো। তাদের ভিটে মাটি দখলে নিয়েছিলো।
রোহিঙ্গাদের একটা অংশ আবার আশা করছেন সুচির নেতৃত্বাধীন এনইউজি ক্ষমতায় এলেই অবসান হবে রোহিঙ্গা সংকটের। তবে, ইতিহাস বলছে, সুচিও রোহিঙ্গাদের দূরে ঠেলেছেন। গণহত্যা অস্বীকার করেছেন। এমনকি সুচির এনইউজি সরকারেও রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে রাখা হয়নি কোনও প্রতিনিধি।
এমন অবস্থায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার বিরোধী জোট রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেটির লিখিত দলিল চান রোহিঙ্গারা।