‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
কবিগুরুর কালজয়ী এই গানের সুরে সুরে বাঙালীর জীবনে এসে পড়লো আরেকটি পহেলা বৈশাখ; আরেকটি নতুন বছর। বিদায়ী ১৪৩০ এর সব ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা, গ্লানি আর না পাওয়াকে ভুলে নতুন উদ্যমে ১৪৩১কে স্বাগত জানানোর প্রহর গুণছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরো জাতি। ভোরের আলো ফুটলেই প্রাণের উৎসবে মাতবে সারাদেশ।
বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। তাই বৈশাখ মাসকে বলা হয় মেলার মাস। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে যে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় তা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
তাই পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের চিরন্তন উৎসব, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই দিন আমাদের আপন শিকড়ের প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার দিন, বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। আবহমান এই লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে বর্ষবরণ উৎসবে মেতে ওঠে দেশের প্রতিটি শহর-গ্রাম-নগর-বন্দর। রাজধানীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান রমনা বটমূল ছাড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে নগরজুড়ে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বৈশাখের প্রথম দিনটিতে ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। বর্ষবরণের আনন্দ-উৎসবে মুখরিত থাকে সমগ্র দেশ।
শুধু আনন্দ-উৎসবই নয়, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। প্রাচীনকাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠানোর পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হালখাতা খোলার চল আছে গ্রামীণ জনপদে।
বৈশাখি মেলা, উৎসবের আয়োজন, হালখাতা তৈরি, মিষ্টান্ন বিতরণ, ভালো ভালো খাবার পরিবেশন—এসব বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যেরই অংশ। এই একটি দিনে কোনো ভেদাভেদ থাকে না বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে। নববর্ষের উৎসব হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
অতীতে আমরা দেখেছি কিছু ধর্মান্ধ মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে চেয়েছে বর্ষবরণের উৎসবে। কিন্তু বাঙালি জাতি কোনো দিনই তা মেনে নেয়নি। সব ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই বাংলার প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি ঘরে উদযাপিত হয়েছে নববর্ষের উৎসব। বাঙালির সংস্কৃতি ধ্বংসের যে অপচেষ্টা তদানীন্তন পাকিস্তানে শুরু হয়েছিল, তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে যে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিল ছায়ানট, তা আজও বাঙালির এক অমলিন ঐতিহ্য। অপশক্তির বোমা হামলাও ছায়ানটের এই যাত্রাকে থামাতে পারেনি। বরং বাঙালির প্রাণের এই উৎসব আজ বিশ্ব ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে গেছে।
কল্যাণ ও নতুন জীবনের বার্তা বয়ে আনে নববর্ষ। বাংলার ঘরে ঘরে আজ তাই উৎসবের আমেজ। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পথে নেমে আসার অপেক্ষায় দেশবাসী। ভোরের আলোয় গান গেয়ে আর মানুষের মঙ্গল কামনায় শোভাযাত্রা বেরুবে রাজধানীসহ সারাদেশে। নতুন বছরটিকে বরণ করে নিতে দেশব্যাপী থাকছে নানা আয়োজন। সরকারি ছুটি ঘোষণা করে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে ছায়ানট। এছাড়াও যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। আবশ্যিকভাবে জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে নববর্ষের মূল অনুষ্ঠান।
বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কোর এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন করা হবে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা)।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতু-নির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাবনিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে শুরু হয় বর্ষবরণ।
মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব স্বমহিমায় নিজের স্থান করে নেয় নাগরিক জীবনে। পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ধীরে ধীরে বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয় ইউনেস্কো।