দেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) ১৪ বছরে পা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, শনিবার (৭ জানুয়ারি) টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার পদার্পন করছে পঞ্চম বছরে। দীর্ঘ ও টানা ক্ষমতায় থাকা এই ঐতিহ্যবাহী দলটি বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
আওয়ামী লীগের এই ১৪ বছরে দলটি বাংলাদেশকে একটি দূর্বল অর্থনৈতিক দেশ থেকে সব শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পদার্পন করিয়েছে। আর তা করতে গিয়ে মানুষের জীবনমানকে উন্নত করতে হয়েছে, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাবমেরিন ক্যাবল (২০২০ সালে শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২০২৪ সালে) থেকে শুরু করে ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রমাণ করে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই ১৪ বছরে উন্নয়নের চিত্র কতটা অর্থপূর্ণ ছিল।
২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে তখন কত দুরাবস্থাই না ছিল। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া এই দল ও তার উত্তরসূরি যে কিনা তারই সুযোগ্য কন্যা টানা ১৪ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের বলে বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে এই সময়ের মধ্যেই বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। এই সময়ে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়নই হয়েছে। তবে যেসব উন্নয়ন দেশকে বদলে দিয়েছে বা দিচ্ছে সেই মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের সফলতার স্বাক্ষর বহন করছে। এই প্রকল্পগুলো বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আকাশে উৎক্ষেপনের পর এর সার্বিক নিয়ে বিবিসি একটি রিপোর্ট করেছিল। রিপোর্টটির সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ এবং উৎক্ষেপনের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যয় হয়েছিল প্রায় দুই হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। উৎক্ষেপণের সময় থেকে স্যাটেলাইটটির মেয়াদকাল ১৫ বছর বলা হলেও মেয়াদকাল আরও তিন বছর বাড়িয়ে ১৮ বছর সম্প্রসারিত করা সম্ভব বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে। এর ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া। পনের বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে অরবিটাল স্লট কেনা হয়েছে। তবে বিএস ওয়ানের স্থায়িত্ব হতে পারে ১৮ বছর পর্যন্ত। তিন দশমিক সাত টন ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির ডিজাইন এবং তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। আর যে রকেট এটাকে মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে সেটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর তিন বছর পূর্তিতে প্রকাশিত বিবিসির এই রিপোর্টটিতে আয়ের বিবরণও তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে জানানো হয় তিন বছরে এই স্যাটেলাইট আয় করেছে ৩০০ কোটি টাকাও বেশি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশের নিজস্ব এই স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের টানা ১৪ বছরের শাসনক্ষমতার সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন এটি।
অদম্য সাহসিকতার পদ্মা সেতু
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪ বছরে সবচেয়ে বড় সাফল্য বলা যেতে পারে পদ্মা সেতু। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাস্তবায়ন হয় ২০০১ সালে এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। এরপর মাঝের কয়েক বছর দেশের ক্ষমতায় না থাকার কারণে এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ঝুলে যায়। ২০০৮ সালে দেশের ক্ষমতায় আসার পর আবার এই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার ব্যয়ে নির্মিত হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করে এই সেতু। নির্মাণ ও আধুনিকতায় এই সেতু বিশ্বে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
মেট্রোরেলের যাত্রা হলো শুরু
বাংলাদেশে একদিন মানুষ আকাশ পথে রেলে চলাচল করবে, দীর্ঘদিনের চলার পথে যানজটমুক্ত জীবন উপভোগ করবে- এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন প্রায় বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। ইতিমধ্যে মেট্রোরেলে তিনটি রুটের মধ্যে একটি রুটের সংক্ষেপিত পথের অর্থাৎ যেটা উত্তরা থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিলের দিকে যাবে তার একটি অংশ আগারগাঁও পর্যন্ত উদ্বোধন হয়ে গেছে। গত হওয়া বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এই পথে মেট্রোরেলে চড়ে উদ্বোধন করেছেন। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাকি রুটের রেলপথ সবার জন্য উম্মুক্ত হবে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) দেওয়া তথ্যানুসারে, কর্মঘণ্টা কাজে লাগিয়ে ও যানবাহন পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে প্রতিবছর মেট্রোরেল থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হবে। এই পথে মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এই মেট্রোরেল আওয়ামী লীগের ১৪ বছরের সক্ষমতার চিহ্ন হিসেবে বহন করছে।
বঙ্গবন্ধু টানেল
খুব শিগগিরই উদ্বোধন হবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর টানেল। এই টানেল চালু হওয়ার পর কক্সবাজারের সঙ্গে সড়কে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। ৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয় পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একদিনে একশ সেতু ও সড়ক উদ্বোধন
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একদিনে একশো সেতু ও সড়ক উদ্বোধনের বিরল নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর দেওয়া তথ্যানুসারে, সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক রয়েছে। একদিনে একশ রাস্তা উদ্বোধনের সরাসরি সুবিধাভোগ করতে পারবে ৫১টি জেলা। এ ছাড়া নতুন সেতুগুলো দুর্গম অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতায়াতকে সুগম করবে। রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত জায়গায় চলাচলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে এসব সেতু ও সড়কের মাধ্যমে। এই নির্মাণ সরকারের সক্ষমতা বিশ্বের দরবারে খুব ভালভাবেই তুলে ধরেছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েরে নির্মাণ। এর দৈর্ঘ্য হবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুরু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের কুতুবখালীতে শেষ হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০২২ সালের নভেম্বরে উদ্বোধন হয়েছে। এটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে উদ্বোধন হওয়ার চার বছরের মধ্যে।
উন্নত দেশের নিদর্শন এই স্থাপনা নির্মাণ শুরু অফিসিয়ালি নভেম্বরে হলেও আদতে এটি আরও আগে থেকেই চলছে। বর্তমানে নির্মাণকাজের এক-তৃতীয়াংশই শেষ হয়ে গেছে। এই স্থাপনা উন্নত বাংলাদেশের স্বাক্ষর রাখে। আওয়ামী লীগে ১৪ বছরের সফলতার গল্প তৈরিতে জোরদার ভূমিকা রাখছে। আওয়ামী লীগের ১৪ বছরে অনেক কিছুই করা হয়েছে যা আগে বাঙালি দেখেনি। উন্নত বাংলাদেশের পথে দ্রুতগতিতে হাটছে বাংলাদেশ। সেই পথের যাত্রায় উল্লেখ করা উন্নয়নের ভিত্তি ছাড়াও সাবমেরিন কেবল, পায়রা সমুদ্র বন্দর, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই ১৪ বছরে বাংলাদেশের দারিদ্রের হার ৪০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শিক্ষায় তো আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়েছে।
আরও অনেক কিছু বলা যায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উল্লেখ করা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, একশো সেতু ও সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার পথে শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের শাসন ক্ষমতার এই ১৪ বছরে সব সমালোচনা চাপা পড়ে উন্নয়ন কাজ এগিয়ে চলেছে। মানুষ যা কখনও কল্পনা করতে পারেনি তা এখন দৃশ্যমান। যেগুলোর বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানকে আরও উন্নত করেছে। আওয়ামী লীগের এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বিদেশিরাও ভূয়সী প্রশংসা করে অংশীদার হতে চাইছে। এগুলো প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের এই সময়ের সফলতার গল্প কতটা বাস্তব। বাংলাদেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগের টানা এই ১৪ বছর কতটা সুফল বয়ে নিয়ে এসেছে তাই প্রমাণ করে।